আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেল (৩রা মার্চ, ১৮৪৭ - ২রা আগস্ট, ১৯২২) প্রখ্যাত বিজ্ঞানী ও উদ্ভাবক। টেলিফোনের বোবাদের পিতা তথা দ্য ফাদার অফ দ্য ডিফ
নামে ডাকা হতো। তার বাবা, দাদা এবং ভাই সবাই একক অভিনয় ও বক্তৃতার কাজে
জড়িত ছিলেন এবং তার মা ও স্ত্রী উভয়েই ছিলেন বোবা। এ কারণেই বোবাদের
জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে তিনি অনেক গবেষণা করেছেন। টেলিফোন উদ্ভাবনের আগে থেকেই তিনি শ্রবণ ও কথন সংশ্লিষ্ট গবেষণা নিয়োজিত ছিলেন। ১৮৭৬ সালে তাকেই টেলিফোনের প্রথম মার্কিন পেটেন্টের সম্মানে ভূষিত করা হয়।
অন্যতম আবিষ্কারক হিসেবে তিনি সবচেয়ে পরিচিত। তাকে
পরবর্তী জীবনে বেল আরও বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা করেন যার মধ্যে রয়েছে উড়ো নৌকা এবং বিমানচালনবিদ্যা। ১৮৮৮ সালে প্রতিষ্ঠিত ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক সোসাইটির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন বেল।
তার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য উদ্ভাবন যে টেলিফোন, সেটিকেই তিনি এক উটকো ঝামেলা
জ্ঞান করতেন। এজন্যেই নিজের গবেষণা ও অধ্যয়ন কক্ষে কোন টেলিফোন রাখতেন
না। বেল মারা যাওয়ার পর আমেরিকার সকল টেলিফোনে এক মিনিটের জন্য অবিরাম রিং
বাজানো হয়। মার্কিন প্রশাসনের ভাষ্য মতে যে মহান ব্যক্তি মানুষে-মানুষে
যোগাযোগের এ পদ্ধতি আবিষ্কার করেছেন তাকে উপযুক্ত সম্মান দেখানোর জন্যই
এমনটি করা হয়েছে।
প্রথম উদ্ভাবন
শিশুকাল
থেকেই আলেকজান্ডার প্রাকৃতিক পরিবেশ সম্পর্কে অত্যন্ত কৌতূহলি ছিলেন এবং
এরই পরিপ্রেক্ষিতে তিনি পরীক্ষানিরীক্ষা করার জন্য বিভিন্ন উদ্ভিদের নমুনা
সংগ্রহ করতেন। ছোটবেলায় আলেকজান্ডারের সবচেয়ে ভাল বন্ধু ছিলেন বেন
হের্ডম্যান। হের্ডম্যানের পরিবার আলেকজান্ডারের প্রতিবেশি ছিলো এবং একটি ময়দা
মিল পরিচালনা করত। একবার আলেকজান্ডার প্রশ্ন করেছিলো যে ময়দা প্রস্তুত
করতে হলে কি কি করতে হয়, এই প্রশ্নের জবাবে তাকে বলা হয়েছিলো যে
পরিশ্রমসাধ্য এক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে গমের খোসা ছাড়িয়ে ময়দা প্রস্তুত
করতে হয়। মাত্র ১২ বছর বয়সে পেরেকের ব্রাশ এবং ঘুর্ণায়মান প্যাডেলের
সমন্বয়ে আলেকজান্ডার একটি গম পেষাই যন্ত্র তৈরী করেন যা ঐ মিলে অনেক বছর ধরে ব্যবহার করা হয়েছিল। এই উদ্ভাবনের জন্য জন হের্ডম্যান আলেকজান্ডার এবং বেনকে নতুন নতুন জিনিস উদ্ভাবন করার গবেষণা করার জন্য একটি ওয়ার্কশপ উপহার দেয়।
জীবনের প্রথম দিক থেকেই আলেকজান্ডার সঙ্গীত এবং কলার প্রতি অত্যন্ত
সংবেদনশীল ছিলেন যা তার মায়ের অণুপ্রেরনায় আরোও উদ্ভাসিত হয়েছিল। কোন
প্রথাগত প্রশিক্ষন ছাড়াই অনেক অল্প বয়সেই তিনি একজন পিয়ানোবাদক হয়ে
ওঠেন। শৈশবে তিনি মুখাভিনয় এবং বিভিন্ন প্রকারের শব্দ উৎপাদনের মাধ্যমে
পরিবারে আগত অতিথিদের মনোরঞ্জন করতেন। তার মায়ের ক্রমবর্ধমান বধীরতা
(আলেকজান্ডারের মা মাত্র ১২ বছর বয়সে শ্রবণশক্তি হারাতে শুরু করেন) তাকে
ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছিল। তার মায়ের সাথে কথোপোকথনের জন্য তিনি
সাংকেতিক ভাষা রপ্ত করেন যাতে করে তিনি নীরব থেকেই মায়ের সাথে কথা বলতে
পারেন। তার মায়ের বধিরতা নিয়ে কাজ করতে গিয়েই আলেকজান্ডার শব্দবিজ্ঞান
নিয়ে পরাশুনা শুরু করেন। আলেকজান্ডারের পরিবার বহুকাল থেকেই বক্তৃতাকৌশল
শিক্ষাদানের কাজ করে আসছিল। লন্ডনে তার দাদা আকেলজান্ডার বেল, ডাবলিনে তার চাচা এবং এডিনবার্গে
তার বাবা সকলেই এই পেশার সাথে যুক্ত ছিলেন। এই বিষয়ের উপর আলেকজান্ডারের
বাবার অনেক প্রকাশনা আছে যার কতগুলো আজকের যুগেও অনেক জনপ্রিয় বিশেষ করে
১৮৬৯০ সালে প্রকাশিত দ্যা স্ট্যান্ডার্ড এলোকিউশনিস্ট।
দ্যা স্ট্যান্ডার্ড এলোকিউশনিস্ট এডিনবার্গে প্রকাশিত হয় ১৮৮৬ সালে এবং
এর ১৬৮ টি ব্রিটিশ সংস্করন শুধুমাত্র যুক্তরাষ্ট্রেই প্রায় ১২ লাখ কপি
বিক্রি হয়। কিভাবে বধির মানুষদের অপরের ঠোঁটের নরাচরা দেখে ভাব বোঝার
প্রশিক্ষন দেওয়া যায় এই বইতে তার বিস্তারিত বিবরন ছিল। কিশোর
আলেকজান্ডারকে এবং তার দুই ভাইকে তাদের বাবা এই পদ্ধতি রপ্ত করতে সাহায্য
করেছিলেন। প্রশিক্ষনের ফলে আলেকজান্ডার এতটাই পারদরশি হয়ে উঠেছিলেন যে
তিনি তার বাবার সাথে বিভিন্ন কর্মশালায় যেতেন এবং নিজেই পদ্ধতিগুলো
প্রদর্শন করে দর্শকদের মুগ্ধ করতেন। ধীরে ধীরে তিনি এই কাজে এতটাই সক্ষম
হয়ে উঠেছিলেন যে কোন পূর্ব অভিজ্ঞতা এবং উচ্চারন জ্ঞান ছাড়াই ল্যাটিন,
স্প্যানিশ, স্কটিশ, গেলিক কিংবা সংস্কৃত যেকোন ভাষাই সংকেতের মাধ্যমে
প্রকাশ করতে পারতেন
শিক্ষা
ভাইদের মত আলেকজান্ডারও ছোটবেলায় পরিবারে বাবার কাছ থেকেই শিক্ষা লাভ করে। যদিও খুব অল্প বয়সেই তাকে এডিনবার্গের রয়েল হাই স্কুলে ভর্তি করা হয়েছিল, সেখানে তিনি চার ক্লাস
পর্যন্তই পড়াশোনা করেন এবং মাত্র ১৫ বছর বয়সেই স্কুল ছেরে দেন। স্কুলে
তার ফলাফল খুব একটা ভাল ছিল না এবং প্রায়শই স্কুল কামাই দেওয়ার প্রবনতা
দেখা গিয়েছে। তার বাবার উচ্চাশা সত্ত্বেও স্কুলের পাঠ্যবিষয়গুলোর প্রতি
আলেকজান্ডারের কোন আগ্রহই ছিল না বরং বিজ্ঞান এবং বিশেষ করে জীববিজ্ঞানে তার মারাত্বক আগ্রহ ছিল। স্কুল ত্যাগ করার পর আলেকজান্ডার তার দাদার সাথে বসবাস করার জন্য লন্ডনে
গমন করেন। লন্ডনে তার দাদার সাথে থাকার সময় পরাশুনার প্রতি তার গভীর
ভালবাসা জন্মায় এবং প্রায়শই তার দাদার সাথে বিভিন্ন বিষয়ের উপর আলোচনা
এবং পরাশুনা করে তার ঘন্টার পর ঘন্টা কেটে যেত। দাদা আলেকজান্ডার বেল তার
নাতিকে তারই শিক্ষানবিশ শিষ্য হিসেবে গ্রহণ করেন এবং তাকে এই বিষয়ের
প্রশিক্ষক হিসেবে গড়ে তোলার জন্য কঠোর পরিশ্রম করেন। মাত্র ১৬ বছর বয়সেই
আলেকজান্ডার শিক্ষানবিশ শিক্ষক হিসেবে স্কটল্যান্ডের
ওয়েস্টন হাউস একাডেমিতে যোগদান করেন। যদিও তখন তিনি ল্যাটিন এবং গ্রিক
ভাষার ছাত্র ছিলেন, তিনি তার পরিচালিত প্রত্তেকটি ক্লাসের জন্য ১০ পাউন্ড
করে পেতেন। এর পরের বছর তিনি এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন যেখানে তার বড় ভাইও পড়েছিলেন। ১৮৬৮ সালে স্বপরিবারে কানাডা চলে যাওয়ার আগে তিনি লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তার ম্যাট্রিকুলেশন সম্পন্ন করেছিলেন।
0 comments:
Post a Comment